স্বার্ণব বাগচী ওরফে তাতান, স্যাটান তাতান নামেই যিনি গানের জগতে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন। তাতানের জন্ম শিল্পের আঁতুড় ঘরে। বাবা সুপরিচিত চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর শ্রী মানব বাগচী। মা শ্রীমতি স্থিতা পাল বাগচী পেশায় উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষিকা এবং বাচিক শিল্পী। শিক্ষা এবং দীক্ষার এই আলােকিত অঙ্গনে তাতানের বড় হয়ে ওঠা।। ঘুণ ধরা বর্তমান সমাজের পচনশীল প্রচলিত রীতি নীতির বিরুদ্ধে তাতানের তীব্র আশ্লেষ তার লেখনীর মধ্যে, গানের মধ্যে, যাপনের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সােশ্যাল মিডিয়াতে Satan Tatan, অর্থাৎ শয়তান তাতান এই নাম বেছে নেওয়ার মধ্যে সমাজের প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া এক তীব্র ব্যঙ্গ,উপহাসের ছায়া দেখা যায়। অথবা খুঁজে পাওয়া যায় সমস্ত কালাে অন্ধকার কে শয়তানের মতােই নিজের বুকে শুষে নেওয়ার প্রচেষ্টার।
তাতান জীবনে থিতু হতে পারেনি, বলা ভালাে থিতু হওয়ার চেষ্টাও সেরকম ভাবে করেনি। তাতানের শিল্পীসত্তা, অভিমান, জেদ, কপট সমাজের প্রতি আন্তরিক বিদ্রোহ বরাবর তার মধ্যে জন্ম দিয়েছে এক তীব্র অস্থিরতার। এই অস্থিরতা যখন তাকে খাদের কিনারে টেনে নিয়ে গেছে তখনও সে অকুতােভয়, যেন জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন। বর্তমান সমাজ আবহে আপােষ করে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুর প্রতি তার অনির্বচনীয় প্রেম বারবার ফুটে উঠেছে তার লেখনীতে। এই মৃত্যুই যেন বর্তমানের প্রতি তার শ্লেষভরা তাচ্ছিল্য।
এই অল্প বয়সে তাতানের গভীর জীবনবোধেও আমাদের চমকিত করে। ভারত তথা সমগ্র বিশ্বজুড়ে যে অস্থিরতা, শােষণ, নিপীড়ন, অবিচার চলছে তা বারবার প্রতিফলিত হয় তার লেখায়, গানে, তার পংক্তি গুলিতে। এগুলাে আমাদের দাঁড় করায় এক অদৃশ্য আয়নার সামনে, আর আমরা বাধ্য হই চোখ নামিয়ে নিতে, কেননা আমরা মুখােমুখি হই অসহ্য সত্যের।
তাতানের কথায় – জীবনের গতিপথে/ মুহূর্তে প্রতিপদে/ দেখেছি শ্মশান / মানুষ উপাধি পাওয়া/ ভয়ে পাল্টি খাওয়া/ সরীসৃপের খাদান।
মৃত্যু তাতানের নশ্বর দেহ কেড়ে নিয়েছে। শিল্পী ও স্রষ্টা তাতান যা ছেড়ে রেখে গেছে তাও বড় অল্প নয়। তার লেখা গান, সৃষ্টি বরাবর ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের। তাতানের জীবন বােধ, জীবনদর্শন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সমাজের ভন্ডামাে, চিনিয়ে দেবে মুখােশের রং। এই অবেলায় তাতানের চলে যাওয়ায় এক বিপুল সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হল আর বড় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের।
শিক্ষাগত যােগ্যতা - Civil Engineer (Diploma), মাধ্যমিকে ৭৮% (২০১১) এবং Diploma ৬৮% JLD College (২০১৫), এর পর সঙ্গীতের জগতে সম্পূর্ণভাবে মনােনিবেশ।
সঙ্গীতগুরু:
আচার্য জয়ন্ত বােস(শাস্ত্রীয়) ও শ্ৰীযুক্ত অভিজিৎ বােস(লােকগীতি)
গীটার গুরু:
অমিত দত্ত ও অমর মল্লিক।
সাড়ে ৫ বছর বয়স থেকে প্রায় ২৭ বছর বয়স পর্যন্ত তার গান শেখা। তার প্রথম দিকের শিক্ষাগুরু শ্রীমতী শুক্তি ব্যানার্জী, শ্রীমতী নূপুর সৎপথী, আমীর খাঁ-র ছাত্র শ্রী কমল চৌধুরী। অঙ্কনেও সে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই শিল্পীর মৃত্যু হয় হেপাটাইটিস-এর মতাে এক ভয়ঙ্কর রােগের কবলে। ২৭ বছর পূর্ণ হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে সে ইহজগত ত্যাগ করে অনন্তলােকের পথে যাত্রা করে।
জন্ম- ২৩.০৫.১৯৯৫, ঝাড়গ্রাম
মৃত্যু- ০৮.০৫.২০২২, কোলকাতা